শিশুর বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশ

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - গার্হস্থ্য বিজ্ঞান - শিশুর বর্ধন ও বিকাশ | | NCTB BOOK

আমাদের চারপাশে যে মানুষগুলোকে আমরা দেখি তারা সবাই এক রকম নয় কেন? জন্ম অবস্থায় শিশুর মধ্যে কি এমন প্রবণতা থাকে যার কারণে তার দেহের আকৃতি, গঠন, চেহারাসহ আচরণ, গুণাবলি অন্যদের থেকে আলাদা হয়? নাকি সে যে পরিবেশে জীবনযাপন করে তার প্রভাবেই তার সারা জীবনের বিকাশ নিয়ন্ত্রিত হয়! এসব প্রশ্ন নিয়ে মনোবিদ, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক যুগ যুগ ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। গবেষণার মাধ্যমে তারা শিশুর বিকাশে বংশগতি কীভাবে কাজ করে, বিকাশে পরিবেশের ভূমিকা কী এসব বিষয়ে ধারণা লাভ - করেন। আমরা এখন এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানব ।

বংশগতি

মেয়েটির গায়ের রং একেবারে তার দাদির মতো। ছেলেটি বাবার মতো সাহসী কিংবা মেয়েটি মায়ের মতোই গানের গলা পেয়েছে। এরকম উক্তি আমরা সব সময়ই শুনে থাকি। শিশু জন্মসূত্রে তার বাবা-মা কিংবা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে যে বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে সেটাই বংশগতি। বংশগতি দিয়ে শিশু তার জীবন শুরু করে। বংশগতির কারণে মানুষের সন্তান মানুষের মতো দেখতে হয়, অন্য কোনো প্রাণীর মতো হয় না। আবার উচ্চতা, দেহের গঠন, চুল, চোখ, চামড়ার রং ইত্যাদি দৈহিক গুণাবলি এবং বিভিন্ন মানসিক গুণাবলি বংশগতির কারণে একেক জনের একেক রকম হয়। বংশগতির প্রভাব জীবনের সূচনা থেকে শুরু করে সারা জীবনব্যাপী চলতে থাকে।

বংশগতির সূচনা হয় মাতৃগর্ভ থেকে। বাবার শুক্রাণু ও মায়ের ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে ভ্রুণ বা জীবকোষ (Zygote) তৈরি হয়। জীবকোষের প্রধান তিনটি অংশ হচ্ছে কোষ প্রাচীর, প্রোটোপ্লাজম এবং নিউক্লিয়াস । নিউক্লিয়াস হলো জীবকোষের প্রাণকেন্দ্র। প্রতিটি মানব জীবকোষের নিউক্লিয়াসে ২৩ জোড়া বা ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে। প্রতিটি জোড়ার একটি আসে মাতৃকোষ থেকে অন্যটি পিতৃকোষ থেকে। মা ও বাবার কাছ থেকে পাওয়া ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের ২২টি জোড়াই ছেলে ও মেয়ের ক্ষেত্রে একই রকম থাকে। এই ক্রোমোজোমগুলো উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য শিশুর মধ্যে বহন করে। বাকি একজোড়া ক্রোমজোম ছেলে ও মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে থাকে ভিন্ন রকমের যা নির্ধারণ করে সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে । এই ২৩ তম জোড়াটিই লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম

মায়ের ডিম্বকোষ থেকে ভ্রুণে যে লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম আসে তা সবসময়ই X টাইপ ক্রোমোজোম হয় ৷ বাবার শুক্রাণু থেকে যে লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম আসে তা কখনো X, কখনো Y টাইপ হয়ে থাকে। যদি মায়ের X ক্রোমোজোমের সাথে বাবার X ক্রোমোজোমের মিলন ঘটে তাহলে মেয়ে শিশু জন্ম নেয়। আর যদি মায়ের X ক্রোমোজোমের সাথে বাবার Y ক্রোমোজোমের জোড় বাঁধে তবে ছেলে শিশু জন্ম নেয়। আমরা দেখি দুটি শিশু কখনোই এক রকম হয় না। আমাদের আপন ভাইবোনের মধ্যেও পার্থক্য থাকে। কেন এমন হয়?

 

 

ক্রোমোজোমের এক এক জোড়া জিন মানুষের এক একটি বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। যার ফলে কেউ বেশি বুদ্ধিমান, কেউ বা কম, কেউ বেঁটে, কেউ বা লম্বা ইত্যাদি হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, মায়ের ক্রোমোজোম থেকে আসা কোন জিনটি বাবার ক্রোমোজোম থেকে আসা কোন জিনটির সাথে জোড়া বাঁধবে, তার কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। এ কারণে একই পিতামাতার সন্তানের মধ্যেও পার্থক্য দেখা যায়। তোমাদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে অনেক সময় যমজ সন্তানের চেহারা ও আচরণ একই রকম হয় কীভাবে? একমাত্র সমকোষী যমজ শিশুর ক্ষেত্রে এ রকম হতে পারে ।

যমজ শিশু দুই ধরনের হয়। সমকোষী যমজ (Identical Twin) ও ভিন্নকোষী যমজ (Fraternal Twin)। যখন একটি জীবকোষ বা জাইগোট ভেঙ্গে দুটি ভ্রুণে পরিণত হয়; তখন তারা একই লিঙ্গের হয় এবং একই রকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। এরাই সমকোষী যমজ

ভিন্নকোষী যমজদের ক্ষেত্রে একাধিক ডিম্বাণু একাধিক শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়। অনেক সময়ে দেখা যায় মায়ের একাধিক ডিম্বাণু পরিপক্ক থাকে। এরূপ ক্ষেত্রে একাধিক শুক্রাণু একাধিক ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে জাইগোট গঠন করে। এ ধরনের যমজ দুজনেই ছেলে বা দুজনেই মেয়ে বা একটি ছেলে, একটি মেয়ে হতে পারে। দুই এর বেশি জাইগোট তৈরি হলে সন্তান সংখ্যাও দুই-এর অধিক হয়। ভিন্নকোষী যমজদের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যের মিল থাকে না। এদের বৈশিষ্ট্য সাধারণ ভাইবোনদের মতো হয়ে থাকে। শুধু পার্থক্য এটুকুই থাকে যে সাধারণ ভাইবোনেরা এক বছর বা তারও বেশি সময়ের ব্যবধানে জন্ম নেয়। ভিন্নকোষী যমজ একই দিনে জন্ম গ্রহণ করে।

 

 

শিশুর বিকাশে পরিবেশ-

শিশুর বিকাশে জন্মপূর্ব পরিবেশ ও জন্ম পরবর্তী পরিবেশ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাতৃগর্ভে শিশু যে ৪০ সপ্তাহকাল অবস্থান করে সেটিই জন্মপূর্ব পরিবেশ। ভ্রুণ অবস্থায় মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার উপর শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক গঠন ও বিকাশ নির্ভর করে। যেমনগর্ভবতী মায়ের পুষ্টিহীনতায় ভ্রুণশিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হয়। আবার মায়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে হলে সন্তান ধারণে মা ও শিশু উভয়ের জীবনে ঝুঁকি থাকে ।

জন্ম পরবর্তী পরিবেশ শিশু জন্মের পর হতে শুরু হয়। জন্ম পরবর্তী পরিবেশ দুই ধরনের হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশ। ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া, জলবায়ু, আলো-বাতাস, গাছ-পালা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, পশু-পাখি ইত্যাদি প্রাকৃতিক পরিবেশ। সমতল ভূমির একটি ছেলের চেয়ে পাহাড়ি এলাকার একটি ছেলের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। সমতলের তুলনায় পাহাড়ি অঞ্চলে জীবন ধারণ করা অনেক কষ্টসাধ্য বলে ওই অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা হয় কর্মঠ ও পরিশ্রমী।

সামাজিক পরিবেশের মধ্যে আছে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলার সাথি, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, দেশীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি। শিশুর জীবনে মা-বাবা, ভাই-ে -বোন, পরিবারের সদস্যদের স্নেহ-মমতা, সঠিক পরিচালনা পদ্ধতি তার সুষ্ঠু বিকাশে সহায়তা করে। অপর দিকে মা-বাবার অনাদর, অবহেলা, অতিরিক্ত শাসন ইত্যাদি শিশুর বিকাশে অন্তরায় হয়। ছেলে-মেয়েরা জীবনের দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যয় করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, নিয়ম-শৃঙ্খলা, শিক্ষার বিষয়বস্তু শিক্ষাপদ্ধতি ইত্যাদি তথা শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ শিশু বিকাশে প্রভাব ফেলে। এ ছাড়াও সহপাঠী, খেলার সাথি, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবার সহায়তায় শিশুর বিকাশের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হতে পারে।

শিশুর বিকাশে বংশগতি এবং পরিবেশ কোনটির প্রভাব বেশি? এ বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। কারও মতে, শিশুর বিকাশ সম্পূর্ণরূপে বংশগতির উপর নির্ভরশীল। আবার কারও মতে শিশুর বিকাশে পরিবেশের ভূমিকাই মূখ্য । বংশগতিকে যাঁরা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, তাঁদের মতে শিশু যে পরিবেশেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন একমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যাবলি তার বিকাশকে প্রভাবিত করে। যেমন- বুদ্ধিমান মা-বাবার সন্তানেরা বেশির ভাগ বুদ্ধিমান হয়। জন্মের পর ভিন্ন পরিবেশে লালিত-পালিত দুই জন সমকোষী যমজের উপর গবেষণায় দেখা গেছে, ১৪ বছর ভিন্ন পরিবেশে লালিত-পালিত হলেও দুই যমজ বোনের রুচি, পছন্দ, আচরণ ও স্বভাবে কোনো পার্থক্য নেই (গবেষকগেসেল ও থমসন)।

অপরদিকে পরিবেশবাদীরা মনে করেন- ব্যক্তির বিকাশে বংশগতি যাই হোক না কেন, তাকে যদি উপযুক্ত পরিবেশে রেখে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তবে ব্যক্তির কাঙ্ক্ষিত বিকাশ সম্ভব। গ্ল্যাডিস এবং হেলেন নামে দুইজন সমকোষী যমজকে ভিন্ন পরিবেশে পাঠানো হয়; তখন তাদের বয়স মাত্র ১৮ মাস। হেলেন পড়াশোনা করার সুযোগ পেল। কিন্তু গ্ল্যাডিস পড়ার কোনো সুযোগই পায়নি। তাদের ৩৫ বছর বয়সে তুলনা করে দেখা গেছে যে, তাদের মুখের গঠন, চেহারা, আচরণ, মানসিক শক্তি, বুদ্ধিমত্তায় হেলেন গ্ল্যাডিস চেয়ে অনেক উন্নত। সমকোষী যমজ বোন হিসেবে উভয়ের বৈশিষ্ট্য একইরূপ হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় নি । এতে প্রমাণিত হয় পরিবেশের কারণে বিকাশ পার্থক্যপূর্ণ হয়।

পরিবেশ ও বংশগতি উভয়কেই যাঁরা সমর্থন করেন তাঁদের মতে- বিকাশ বংশগতি ও পরিবেশ এই দুই উপাদানের পারস্পরিক ক্রিয়ার দ্বারা নির্ধারিত হয়। উন্নত জাতের বীজ থেকে উন্নত মানের ফলন পাওয়া যায় । কিন্তু বীজ থেকে গাছ হওয়ার জন্য চাই উর্বর মাটি, পর্যাপ্ত পানি, আলো-বাতাস ইত্যাদি। পরিবেশের এই  উপাদানগুলোর অভাবে কখনই উন্নতমানের বীজ হতে উন্নতমানের ফলন সম্ভব হয় না। আবার উর্বর মাটি, পর্যাপ্ত পানি, আলো-বাতাস ইত্যাদি ভালো পরিবেশ বিদ্যমান থাকলেও উন্নত বীজের অভাবে উন্নত মানের ফলন আশা করা যায় না। অর্থাৎ শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে বংশগতি এবং পরিবেশ উভয়েরই গুরুত্ব অপরিসীম।

জন্ম থেকে ক্ষীণ বুদ্ধিসম্পন্ন একটি শিশুকে উন্নত পরিবেশে প্রতিপালন করলেও তার মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। একই ভাবে অধিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যে শিশু জন্ম গ্রহণ করে তাকে যদি তার বুদ্ধি বিকাশের সহায়ক পরিবেশ ও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া না হয়, তবে তার বুদ্ধিমত্তার পূর্ণাঙ্গ পরিস্ফুটন হয় না। উপযুক্ত পরিবেশ শিশুর জন্মসূত্রে পাওয়া বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটায়। তাই বলা যায়- বংশগতি এবং পরিবেশ উভয়েরই পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে শিশুর বিকাশ নির্ধারিত হয়।

কাজ – শিশুর বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশ কোনটির গুরুত্ব বেশি? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে উদাহরণসহ যুক্তি উপস্থাপন কর।

Content added By
Promotion